অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাত : কারণ, প্রতিরোধ ও পরবর্তী করণীয়
গর্ভাবস্থায় গর্ভপাত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল বিষয় যা নারী ও তার পরিবারকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে গর্ভস্থ শিশুর অকাল মৃত্যু ঘটে। গর্ভপাতের কারণ এবং এর পরবর্তী প্রভাব সম্পর্কে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ভুল ধারণা থাকতে পারে, তবে এর বাস্তবতা অনেক বেশি জটিল। সাধারণভাবে গর্ভপাত একটি একক ঘটনা হিসেবে ঘটে, এবং একবার গর্ভপাত হওয়ার পর বারবার গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম (প্রায় ১-২%)।১ গর্ভাবস্থায় গর্ভপাতের বিভিন্ন শারীরিক, জেনেটিক এবং পরিবেশগত কারণ থাকতে পারে, যার মধ্যে কিছু সহজে প্রতিরোধযোগ্য। এই আর্টিকেলে গর্ভাবস্থায় গর্ভপাতের কারণ, এর প্রতিরোধের উপায় এবং পরবর্তী করণীয় বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা গর্ভাবস্থায় গর্ভপাতের ঝুঁকি কমাতে এবং নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখতে সহায়তা করতে পারি।

গর্ভাবস্থায় গর্ভপাতের কারণ
গর্ভপাতের ঝুঁকি প্রথম ত্রৈমাসিকে সবচেয়ে বেশি থাকে। প্রায় ১০০টি গর্ভপাতের মধ্যে ৮০টি ঘটে এই প্রথম ত্রৈমাসিকে।২ গর্ভপাতের কারণগুলো শারীরিক, জেনেটিক, এবং পরিবেশগত হতে পারে। আবার পরিবারের মধ্যে কারও গর্ভপাতের ইতিহাস থাকলে, গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। যদিও এ বিষয়ে এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।৩
জেনেটিক সমস্যা
গর্ভপাতের অন্যতম প্রধান কারণ হলো গর্ভস্থ শিশুর ক্রোমোসোমাল সমস্যা। গর্ভস্থ শিশুর জেনেটিক গঠন ঠিক না থাকলে, এটি গর্ভপাতের দিকে পরিচালিত করতে পারে। প্রায় ৫০% গর্ভপাতের ক্ষেত্রে ক্রোমোসোমাল অস্বাভাবিকতা দায়ী থাকে, যেমন অতিরিক্ত বা কম ক্রোমোসোম। এই ধরনের সমস্যা সাধারণত প্রাকৃতিকভাবে ঘটে এবং এর প্রতিকার করা সম্ভব নয়।

মা-বাবার শারীরিক সমস্যা
মায়ের শারীরিক স্বাস্থ্য গর্ভপাতের ঝুঁকিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিছু শারীরিক সমস্যা যেমন অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস৪, উচ্চ রক্তচাপ, এবং থাইরয়েডের সমস্যা গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। যখন মায়ের শরীরের কোনো সমস্যা থাকে, তখন তা গর্ভস্থ শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, যার ফলে গর্ভপাত হতে পারে। তাছাড়া বাবার জিনগত কিছু ত্রুটিও গর্ভপাতের কারণ হতে পারে। এ জন্য জেনেটিক পরীক্ষা করানো যেতে পারে।৫
অপর্যাপ্ত খাদ্য এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা
অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা এবং অপর্যাপ্ত খাদ্যাভ্যাস গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। যথেষ্ট পুষ্টি না পাওয়া, পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নেওয়া এবং অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম গর্ভপাতের কারণ হতে পারে। এই কারণে, গর্ভবতী মহিলাদের সঠিক পুষ্টি গ্রহণ এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।
ধূমপান, অ্যালকোহল এবং মাদক ব্যবহার
ধূমপান, মদ্যপান৬ এবং মাদক সেবন গর্ভপাতের ঝুঁকি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। গর্ভাবস্থায় ধূমপান গর্ভস্থ শিশুর জন্য গুরুতর ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে, যা শিশুর ক্রমবিকাশে বাধা দেয় এবং গর্ভপাত ঘটাতে পারে । অ্যালকোহল এবং মাদক সেবনও গর্ভাবস্থায় গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ায়, কারণ এসব পদার্থ গর্ভস্থ শিশুর স্নায়ুতন্ত্র এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিকাশে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে ।
পরিবেশগত বিষক্রিয়া
গর্ভাবস্থায় পরিবেশগত বিষক্রিয়া গর্ভপাতের একটি কারণ হতে পারে। তামাকের ধোঁয়া, রাসায়নিক পদার্থ, এবং অতিরিক্ত তাপ পরিবেশগত বিষক্রিয়ার একটি অংশ। গর্ভাবস্থায় এসব বিষক্রিয়া থেকে দূরে থাকা উচিত, কারণ এগুলি গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলতে পারে এবং গর্ভপাতের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে ।
বয়স
নারীর বয়সও গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। বিশেষত বেশি বয়সে গর্ভধারণ করলে গর্ভপাতের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেতে পারে।৪ এই বয়সে গর্ভস্থ শিশুর ক্রোমোসোমাল অস্বাভাবিকতার ঝুঁকি বেশি থাকে, যা গর্ভপাতের কারণ হতে পারে ।
অতিরিক্ত মানসিক চাপ
গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা উদ্বেগ গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। দীর্ঘকালীন মানসিক চাপ শরীরের হরমোনাল পরিবর্তন সৃষ্টি করে, যা গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, যে মহিলারা মানসিক চাপ অনুভব করেন, তাদের গর্ভপাতের ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় বেশি থাকে ।
অস্বাস্থ্যকর শারীরিক চাপ বা কাজ
গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম, যেমন ভারী বস্তু উত্তোলন বা দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকা, গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। বিশেষ করে যারা দৈনিক কঠোর শারীরিক পরিশ্রম করেন, তাদের মধ্যে গর্ভপাতের সম্ভাবনা বেশি থাকে ।
গর্ভাবস্থায় গর্ভপাত প্রতিরোধের উপায়
গর্ভাবস্থায় গর্ভপাত একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে, তবে সঠিক যত্ন এবং সচেতনতামূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে এর ঝুঁকি কমানো সম্ভব। গর্ভপাত প্রতিরোধের জন্য কিছু কার্যকর উপায় রয়েছে, যা গর্ভবতী মহিলাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সাহায্য করতে পারে। নিচে গর্ভাবস্থায় গর্ভপাত প্রতিরোধের কিছু মূল উপায় তুলে ধরা হলো:
স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা
গর্ভাবস্থায় স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে অন্তর্ভুক্ত থাকে:
- সঠিক খাদ্যাভ্যাস: পুষ্টিকর খাবার, যেমন ফল, সবজি, ডাল, শস্য এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা। এটি মা ও শিশুর শারীরিক স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে।
- পর্যাপ্ত পানি পান করা: শরীরকে হাইড্রেটেড রাখার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করা।
- নিয়মিত ব্যায়াম: গর্ভাবস্থায় হালকা ও নিরাপদ ব্যায়াম যেমন হাঁটা, যোগব্যায়াম করা শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে পারে। তবে, কোন ধরনের ব্যায়াম করা হবে তা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হওয়া উচিত।
চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ
গর্ভাবস্থার শুরু থেকে নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসক গর্ভাবস্থার নানা বিষয় যেমন হরমোনের পরিমাণ, শরীরের পরিবর্তন এবং গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্য মনিটর করেন। চিকিৎসক যদি কোনও সমস্যা চিহ্নিত করেন, তবে তা আগেভাগেই সমাধান করা যেতে পারে।
ধূমপান, অ্যালকোহল এবং মাদক থেকে দূরে থাকা
গর্ভাবস্থায় ধূমপান, অ্যালকোহল এবং মাদক ব্যবহার গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ায়। গর্ভধারণের প্রথম দিন থেকে এসব থেকে দূরে থাকা উচিত, কারণ এগুলি গর্ভস্থ শিশুর বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে এবং গর্ভপাতের কারণ হতে পারে।
এনভায়রনমেন্টাল সেফটি
গর্ভাবস্থায় রাসায়নিক দ্রব্য, অতিরিক্ত তাপ, বা তামাকের ধোঁয়া থেকে দূরে থাকা উচিত। গর্ভস্থ শিশুর জন্য এইসব পরিবেশগত বিষক্রিয়া ক্ষতিকর হতে পারে। গর্ভবতী মহিলাদের উচিত যেসব কাজ বা পরিবেশে এসব বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা থাকে সেগুলো এড়িয়ে চলা।
স্ট্রেস কমানো
গর্ভাবস্থায় মানসিক চাপ বা উদ্বেগ কমানোর জন্য কিছু কৌশল গ্রহণ করা যেতে পারে, যেমন:
- ধ্যান ও শ্বাসপ্রশ্বাস ব্যায়াম: এটি মানসিক শান্তি বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে।
- সমস্ত চিন্তা ও উদ্বেগ শেয়ার করা: পরিবারের সদস্য বা মনোবিদের সঙ্গে সমস্যাগুলি আলোচনা করা মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করতে পারে।
কিছু কাজ থেকে বিরত থাকা
গর্ভাবস্থায় ভারী কাজ বা শারীরিক চাপ গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ায়। ভারী বস্তু উত্তোলন বা দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকা থেকে বিরত থাকা উচিত। এছাড়া, অতিরিক্ত পরিশ্রমও গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে, তাই গর্ভাবস্থায় বিশ্রাম নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও টিকা
গর্ভাবস্থায় টিকা নেওয়া এবং সঠিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। কিছু বিশেষ টিকা যেমন, ইনফ্লুয়েঞ্জা বা টেটানাস ভ্যাকসিন গর্ভাবস্থায় গর্ভপাতের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে। এছাড়া, নির্দিষ্ট স্বাস্থ্য পরীক্ষা যেমন, ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড এবং অন্যান্য শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে শারীরিক সমস্যা চিহ্নিত করা যেতে পারে।
পুনরায় গর্ভধারণের জন্য অপেক্ষা
গর্ভপাতের পরে পুনরায় গর্ভধারণের জন্য কিছু সময় অপেক্ষা করা উচিত। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী, গর্ভপাতের পর পরবর্তী গর্ভধারণের জন্য অন্তত ৬ মাস অপেক্ষা করা উচিত যাতে শরীর সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে ওঠে।
শেষ কথা
গর্ভাবস্থায় গর্ভপাত একটি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং মানসিকভাবে কষ্টকর অভিজ্ঞতা, যা নারীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে। গর্ভপাতের কারণগুলো শারীরিক, জেনেটিক, এবং পরিবেশগত বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে, তবে সচেতনতা এবং প্রাথমিক পদক্ষেপের মাধ্যমে এর ঝুঁকি কমানো সম্ভব। গর্ভাবস্থায় সঠিক চিকিৎসা, স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা, এবং মানসিক সাপোর্ট গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভপাতের পর, নারীদের শারীরিক এবং মানসিক ক্ষয়পূরণের জন্য সময় ও সহায়তা প্রয়োজন। চিকিৎসকের পরামর্শ, বিশ্রাম, এবং মানসিক সহায়তা নেওয়ার মাধ্যমে নারীরা এই কঠিন সময়ের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারে। ভবিষ্যতে গর্ভধারণের জন্য উপযুক্ত প্রস্তুতি এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা গ্রহণ গর্ভপাতের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
তথ্য সুত্র
- Duckitt, K., & Qureshi, A. (2015). Recurrent miscarriage. BMJ Clinical Evidence, 2015, 1409.
- Dugas, C., & Slane, V. H. (2022, June 27). Miscarriage. NCBI Bookshelf.
- Woolner, A. M. F., Nagdeve, P., Raja, E. A., Bhattacharya, S., & Bhattacharya, S. (2020). Family history and risk of miscarriage: A systematic review and meta-analysis of observational studies. Acta Obstetricia et Gynecologica Scandinavica, 99(12), 1584–1594.
- Garrido-Giménez, C., & Alijotas-Reig, J. (2015). Recurrent miscarriage: Causes, evaluation and management. Postgraduate Medical Journal, 91(1073), 151–162.
- Suzumori, N., & Sugiura-Ogasawara, M. (2010). Genetic factors as a cause of miscarriage. Current Medicinal Chemistry, 17(29), 3431–3437.
- Andersen, A. M. N., et al. (2012). Moderate alcohol intake during pregnancy and risk of fetal death. International Journal of Epidemiology, 41(2), 405–413.