গর্ভাবস্থায় অরুচি: একটি বিস্তারিত নির্দেশনা
গর্ভাবস্থায় অরুচি একটি সাধারণ সমস্যা। প্রতিটি নারীর জীবনে গর্ভাবস্থা একটি বিশেষ সময় যখন অনেক শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন আসে। ২,২৭০ জন গর্ভবতী নারীর ওপর গবেষিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, মাঝারি থেকে তীব্র বমি বমি ভাব ও বমিতে আক্রান্ত নারীদের মধ্যে যথাক্রমে ৪২% এবং ৭০% নারী গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন।[১] অরুচি বলতে বোঝায় গর্ভাবস্থায় খাদ্যের প্রতি স্বাভাবিক আগ্রহ কমে যাওয়া বা খাবার খেতে অনীহা বোধ করা। মনে রাখতে হবে, খাবারে অরুচি আর নির্দিষ্ট কিছু খাবারের প্রতি বিতৃষ্ণা, দুটি ভিন্ন বিষয়। গর্ভাবস্থায় নির্দিষ্ট কিছু খাবারের প্রতি বিতৃষ্ণা হওয়াটাও বেশ স্বাভাবিক।২ সঠিক পুষ্টির অভাবে মা ও শিশুর উভয়েরই স্বাস্থ্যঝুঁকি হতে পারে। এখানে গর্ভাবস্থায় অরুচির কারণ, লক্ষণ এবং এর সমাধানের উপায়গুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা।
গর্ভাবস্থায় অরুচির কারণ
শারীরিক পরিবর্তন: গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক ঘটনা, যা অরুচির কারণ হতে পারে। হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রফিন (hCG) নামক হরমোন গর্ভাবস্থার শুরুতে দ্রুত বাড়তে থাকে এবং এর ফলে বমি বমি ভাব দেখা দেয়, যা অনেক সময় অরুচির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়াও, ইস্ট্রোজেন হরমোন স্বাদ ও গন্ধের অনুভূতিতে পরিবর্তন আনে, যার কারণে গর্ভবতী নারীরা কিছু বিশেষ খাবারের প্রতি অনীহা অনুভব করতে পারেন। সাধারণত এসব শারীরিক পরিবর্তনের কারণে গর্ভাবস্থায় অরুচি হয়।৩
বমি বমি ভাব ও বমি: মর্নিং সিকনেস গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসের একটি সাধারণ সমস্যা, যেখানে বমি বমি ভাব এবং বমি হওয়ার কারণে খাদ্য গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে খাবারে অরুচি হয়।৪ কিছু নারীর ক্ষেত্রে এই সমস্যা এতটাই তীব্র হয় যে, তাঁরা প্রায় কিছুই খেতে পারেন না, যা তাঁদের শরীরে পুষ্টির অভাব সৃষ্টি করে।
গন্ধের প্রতি সংবেদনশীলতা: গর্ভাবস্থায় নারীদের ঘ্রাণশক্তির পরিবর্তন ঘটে, যা তাঁদের খাবারে অরুচি সৃষ্টি করতে পারে। এ সময় ঘ্রাণশক্তি অনেক বেড়ে যায়, ফলে আগে ভালো লাগা গন্ধও অসহ্য মনে হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, অনেক গর্ভবতী নারী মাছ, মাংস, ডিম, পেঁয়াজ বা কোনো বিশেষ মশলার গন্ধে বমি বমি ভাব অনুভব করেন বা খাবারের প্রতি অনীহা বোধ করেন।৪
কোষ্ঠকাঠিন্য: গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্য একটি সাধারণ সমস্যা। গর্ভাবস্থায় হজম প্রক্রিয়া ধীর হয়ে যাওয়ার কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। এর ফলে পেট ভরা ভরা মনে হয়, যা স্বাভাবিক ক্ষুধা কমিয়ে দেয় এবং খাবারে অরুচি সৃষ্টি করে।
মানসিক চাপ ও উদ্বেগ: গর্ভাবস্থায় মানসিক চাপ ও উদ্বেগ একটি স্বাভাবিক বিষয়। ভবিষ্যৎ, সন্তানের স্বাস্থ্য, এবং প্রসব বেদনা ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা থেকে মানসিক চাপ বাড়তে পারে। তবে, যোগা, মেডিটেশন, শখের কাজ করা এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়ার মাধ্যমে এই মানসিক চাপ কমিয়ে আনা সম্ভব।
বিষণ্নতা: গর্ভাবস্থাকালীন বিষণ্নতা (Prenatal depression) একটি উদ্বেগের বিষয়। হরমোনের পরিবর্তন ও অন্যান্য কারণে গর্ভবতী মহিলারা বিষণ্নতায় আক্রান্ত হতে পারেন। এর প্রধান লক্ষণগুলো হলো ক্রমাগত খারাপ লাগা, কোনো কাজে উৎসাহ না পাওয়া, ঘুমের সমস্যা এবং খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আসা। এই অবস্থায় থেরাপি ও ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করা জরুরি।
ভিটামিন ও খনিজ অভাব: গর্ভাবস্থায় ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের অভাব দেখা দিলে খাবারে অরুচি হতে পারে। ভিটামিন বি১২-এর অভাবে ক্লান্তি, দুর্বলতা ও অরুচি দেখা দেয়। আয়রনের অভাবে রক্তস্বল্পতা (Anemia) হয়, যা ক্ষুধামান্দ্য সৃষ্টি করে। জিঙ্কের অভাবে স্বাদ ও গন্ধের অনুভূতি কমে যাওয়ায় খাবারে অনীহা তৈরি হয়।
থাইরয়েড সমস্যা: গর্ভাবস্থায় থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা দেখা দিলে অরুচি হতে পারে। থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা কমে গেলে বা বেড়ে গেলে শরীরে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়, যার মধ্যে অন্যতম হলো অরুচি। এর পাশাপাশি ক্লান্তি, ওজন পরিবর্তন এবং ঘুমের সমস্যাও হতে পারে। এই অবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করা জরুরি।
সংক্রমণ: গর্ভাবস্থায় যেকোনো ধরনের সংক্রমণ, যেমন ঠান্ডা বা ফ্লু, হলে খাবারে অরুচি দেখা দিতে পারে। এই অবস্থায় পর্যাপ্ত বিশ্রাম, সঠিক পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন।
অরুচির লক্ষণ
- স্বাদ বা গন্ধের অনুভূতি কমে যাওয়া: খাবারের স্বাদ বা গন্ধ তেমন না পাওয়া।
- খাবার দেখলে বা খাবারের গন্ধে অনীহা: বিশেষ কোনো খাবারের প্রতি বিতৃষ্ণা বা গন্ধ সহ্য করতে না পারা।
- পেট ভরা অনুভূত হওয়া বা অল্প খেলেই পেট ভরে যাওয়া: সামান্য খাবারেই পেট ভরে গিয়েছে এমন অনুভূতি হওয়া।
- বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া: বমি ভাব বা বমি হওয়ার কারণে খাবার গ্রহণ করতে না চাওয়া।
- ওজন কমে যাওয়া বা ওজন না বাড়া: স্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধি না হওয়া বা ওজন কমে যাওয়া।
- শারীরিক দুর্বলতা ও ক্লান্তি: শরীরে শক্তি না পাওয়া এবং দুর্বল লাগা।
অরুচি কমানোর উপায়
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন: গর্ভাবস্থায় অরুচি কমাতে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা জরুরি। এক্ষেত্রে অল্প অল্প করে বার বার খাবার খাওয়া একটি ভালো উপায়। এর ফলে পাকস্থলীর ওপর চাপ কম পড়ে এবং হজম প্রক্রিয়া সহজ হয়। উদাহরণস্বরূপ, দিনে ৫-৬ বার অল্প পরিমাণে খাবার গ্রহণ করা যেতে পারে। তাছাড়া গর্ভাবস্থায় টক ফল খেলে বমি বমি ভাব কিছুটা কমতে পারে।৪
পুষ্টিকর খাবার নির্বাচন: গর্ভাবস্থায় অরুচি কমাতে পুষ্টিকর খাবার নির্বাচন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার, যেমন ডিম, মাছ, মাংস ও ডাল খাদ্য তালিকায় যোগ করুন। এছাড়াও, ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার, যেমন বিভিন্ন ফল, সবজি ও শস্য গ্রহণ করুন। পালং শাক, গাজর, মিষ্টি আলু, ব্রকলি, কমলা, ডিম, দই ও বাদামের মতো খাবার আপনার খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন।
পছন্দের খাবার তৈরি: গর্ভাবস্থায় অরুচি দূর করতে পছন্দের খাবার তৈরি করা একটি কার্যকর উপায়। নিজের ভালো লাগার খাবারগুলো স্বাস্থ্যকর উপায়ে রান্না করুন। সাপ্তাহিক খাদ্য তালিকা তৈরি করে খাবার গ্রহণ করতে পারেন, যা আপনাকে সঠিক খাবার নির্বাচনে সাহায্য করবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যখন ক্ষুধা লাগবে তখনই খাবার খান; কোনো নির্দিষ্ট সময় মেনে চলার বাধ্যবাধকতা নেই।
জীবনযাত্রার পরিবর্তন: গর্ভাবস্থায় অরুচি কমাতে জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। পর্যাপ্ত বিশ্রাম শরীরকে পুনরায় সক্রিয় করে তোলে। ঘুমের অভাব অরুচি বাড়াতে পারে, তাই রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানো এবং দুপুরে বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। হালকা ব্যায়াম অথবা হাঁটাচলা করলে হজম প্রক্রিয়া সঠিক থাকে এবং ক্ষুধা বাড়তে সাহায্য করে। হাঁটা, যোগা ও সাঁতারের মতো হালকা ব্যায়াম গর্ভাবস্থায় খুবই উপযোগী।৫
মানসিক চাপ কমানো: মানসিক চাপ গর্ভাবস্থায় অরুচির একটি বড় কারণ। মানসিক চাপ কমাতে যোগা ও মেডিটেশন খুবই উপযোগী। প্রতিদিন কিছু সময় যোগা ও মেডিটেশন করলে মন শান্ত থাকে এবং মানসিক চাপ কমে। এছাড়া, শখের কাজ করা, যেমন গান শোনা বা বই পড়ার মাধ্যমেও মানসিক চাপ কমানো যায়। এই কাজগুলো মনকে আনন্দ দেয় এবং খাদ্য গ্রহণে আগ্রহ বাড়ায়।
ঘরোয়া উপায়: গর্ভাবস্থায় অরুচি কমাতে কিছু ঘরোয়া উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে। আদা হজম ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং অরুচি কমায়। আপনি আদা কুচি করে খেতে পারেন, আদা চা পান করতে পারেন অথবা শুধু আদা মেশানো পানিও খেতে পারেন। লেবুর গন্ধ বা লেবুর শরবত বমি বমি ভাব কমিয়ে খাবারে আগ্রহ বাড়ায়। লেবুর শরবত পান করতে পারেন, লেবুর আচার খেতে পারেন অথবা খাবারের সাথে লেবুর রস মিশিয়েও খেতে পারেন। পুদিনা পাতা দিয়ে চা বানিয়ে অথবা সরাসরি পুদিনা পাতা চিবিয়ে খেলে অরুচি দূর হয়। এছাড়া, পুদিনার শরবত তৈরি করে বা সালাদে পুদিনা পাতা মিশিয়েও খেতে পারেন।
কখন ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে?
- অতিরিক্ত ওজন কমে গেলে।
- দীর্ঘদিন ধরে অরুচি থাকলে এবং কোনো উন্নতি না হলে।
- শারীরিক দুর্বলতা বেড়ে গেলে।
- অন্য কোনো উপসর্গ দেখা দিলে, যেমন - জ্বর, পেটে ব্যথা ইত্যাদি।
উপসংহার
পরিশেষে, গর্ভাবস্থায় অরুচি একটি সাধারণ সমস্যা, তবে সঠিক যত্নের মাধ্যমে এর মোকাবেলা করা সম্ভব। নিজের শরীরের প্রতি মনোযোগ দিন, স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করুন এবং প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। একটি সুস্থ ও সুন্দর গর্ভাবস্থার জন্য ইতিবাচক থাকা অত্যন্ত জরুরি।
তথ্য সুত্র
- Dawson, A., Sloan, N. L., Abdoulaye, I., & Fawzi, W. (2017). The effect of maternal dietary diversity on infant and young child feeding practices: A systematic review. Maternal and Child Nutrition, 13(4), e12428.
- Healthline. (n.d.). Loss of Appetite During Pregnancy: Causes. Healthline. Retrieved from https://www.healthline.com/nutrition/loss-of-appetite-pregnancy#causes
- Hill, A. J., et al. (2016). Nutritional and Clinical Associations of Food Cravings in Pregnancy. Journal of Human Nutrition and Dietetics, 29(3).
- Weigel, M. M., Armbruster, B., Valois, M., & Crespillo, L. (2011). Food aversions and cravings during early pregnancy: Association with nausea and vomiting. Ecology of Food and Nutrition, 50(3), 197–214.
- Regodón Wallin, A., Tielsch, J. M., Khatry, S. K., Mullany, L. C., Englund, J. A., Chu, H., LeClerq, S. C., & Katz, J. (2020). Nausea, vomiting and poor appetite during pregnancy and adverse birth outcomes in rural Nepal: An observational cohort study. BMC Pregnancy and Childbirth, 20(1), 545.